রবিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৭

দ্বৈত অদ্বৈত

দ্বৈত অর্থাৎ 'দুটি'। যারা একের অধিক সত্তায় বিশ্বাসী তাঁদের দ্বৈতবাদী বলা হয়। আমরা নানা দেব দেবীর পূজার্চনা করে থাকি। দেব দেবীকে তুষ্ট করে নিজেদের অভীষ্ট ফল প্রার্থনা করে থাকি। আবার যারা একেশ্বরবাদী তাঁরাও তাঁদের আরাধ্য দেবতার তথা ঈশ্বরের সাধন ভজন করেন। এ সবই হল দ্বৈত ভাবাত্মক। আমরা যে জড় জগতে বিচরণ করি যে জড় জগতে আমি তুমি বসবাস করি, তোমার সঙ্গে আমার মেলামেশা সবই দ্বৈত ভাবাত্মক। কারণ তুমি-আমি এক নই। এই জড় বিশ্বের সমস্ত বস্তুই দ্বৈত ভাবাত্মক - তোমার খাওয়া হলে আমার পেট ভরে না। তাহলে তুমি-আমি এক হই কি করে। বিজ্ঞান বলছে, যে জড় জগৎ আমরা দেখি তা প্রকৃত রূপে একই নির্গুণ সত্তা জাত। আমার সামনে যে বইটি রয়েছে, আমার হাতে যে ঘড়িটি রয়েছে - সবই সেই অসংখ্য অনু-পরমানুর নানা প্রকার সুবিন্যস্ত সমাহারের প্রকাশ। সেই অনু-পরমানু যার নির্মাণ কণা হল সেই ইলেক্ট্রন-প্রোটন-নিউট্রন। এই ইলেক্ট্রন-প্রোটন-নিউট্রন হল আবার একই মৌলিক কণা কোয়ার্ক জাত। তাই এ জগতের প্রতিটি জড় বস্তুই একই মৌলিক সত্তা হতে জাত। সুতরাং জর জগতের ক্ষেত্রে এই সুন্দর সৃষ্টি  শোভার নানারূপ দ্বৈত সত্তা অজ্ঞানতা পূর্ণ। কিন্তু জীব জগৎ!  আমি-তুমি - এই প্রাণী বা উদ্ভিদ জগতের দ্বৈততা? দ্বৈত না অদ্বৈত  - কোন সত্তা সঠিক এই নিয়ে বিচার বহু দিনের। তুমি আমি পৃথক ঠিকই। কিন্তু যখন দেখি তোমার খুশিতে আমার খুশি, তোমার দুঃখে আমার দুঃখ, তোমার আবেগ আমাকেও স্পর্শ করে তখন তুমি আমি এক হয়ে যাই। তখন কোথায় দ্বৈততা। হ্যাঁ, বিভেদ আছে। তোমার সঙ্গে আমার মেলে না অনেক সময়েই। তোমার-আমার নিত্য বিরোধ। কিন্তু যখন অজ্ঞানতা দূর হয়; তোমাকে আরও আরও বেশী জানি, তখন সেই মিল। হ্যাঁ, মিল খুঁজে পাই, একত্ব অনুভব করি - ঠিক। কিন্তু এক সত্তা, তা কিকরে হয়। ভারতীয় দর্শণ বলছেন, প্রাণ যার আছে তিনি প্রাণী। শরীরে যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণ শরীর সচল। এই প্রাণ শরীর ত্যাগ করলেই এই শরীর জড়। অর্থাৎ প্রাণ শরীরের সাথে যুক্ত থেকে শরীরকে পরিচালনা করছে। যদিও বিজ্ঞানীর ভাষায় শরীরের নানা বিক্রিয়ার ফলেই নাকি শরীরে প্রাণের উদ্ভব (যার কোন প্রমাণ বিজ্ঞানী এখনো দিতে পারেন নি)। অদ্বৈতবাদী এইখানেই বিজ্ঞানীর যুক্তিকে খণ্ডন করেন। শরীরের নানা বিক্রিয়ায় যদি প্রাণের সৃষ্টি হত তাহলে কোন বিজ্ঞানী কেন এখনো কোন নতুন প্রাণী সৃষ্টি করতে পারলেন না। শরীরের নানা বিক্রিয়ায়ই যদি প্রাণের সৃষ্টি হয় তাহলে কেন তোমাকে আমি অনুভব করি। কেন এই একত্ব। শারীরিক বিক্রিয়ায় প্রাণের তত্ত্ব এগুলির কোন ব্যাখ্যা দিতে পারে না। অদ্বৈতবাদী বলেন এই প্রাণ অনত্ব এবং বিশ্বব্যাপী। সেই বিশ্বব্যাপী অনন্ত প্রাণের এক এক অপূর্ণ প্রকাশ হলাম আমরা - এই জীব জগৎ - মানুষ-পাহাড়-পশু-পাখি-চন্দ্র-সূর্য প্রভৃতি। এই মহাপ্রাণ তথা পরমাত্মাই নিজেকে প্রকাশ করেছেন এ সৃষ্টির প্রতিটি বিন্দুতে।
হ্যাঁ, এই প্রাণ জীবদেহ ত্যাগ করলেই জীব প্রাণহীন - জড়। একই প্রাণ চালিকা শক্তিরূপে প্রতিটি জীবকে সচল রেখেছে। বিভিন্ন জীবে তাঁর প্রকাশ ভিন্ন ভিন্ন। সুতরাং আমরা পেলাম এক প্রাণ এবং এক জড়। আর  বিজ্ঞান তো যেকোন জড়ের একই নির্গুণ সত্তার কথা আগেই স্বীকার করে নিয়েছে।
তাহলে এই প্রাণ ও জড় – এই দুই সত্তা আমাদের এই জীব জগৎ ও জড় জগৎ সৃষ্টির জন্য দায়ী। কিন্তু এই জড় জগৎ - তা তো প্রকৃতিরই সৃষ্টি। প্রকৃতিই সমস্ত জীব ও জড়ের লালন ও পালন কর্তৃ। আর আছেন বিশ্বব্যাপী অনন্ত প্রাণ তথা মহাপ্রাণ। যে দেব দেবীকে আমরা পূজা করি তা হল সেই বিশ্বব্যাপী অনন্ত প্রাণেরই এক এক প্রকাশ। এ কারণেই যেকোন বৈদিক পূজার্চনায় "যা দেবী সর্বভূতেষু...” , এই রূপ মন্ত্রে আমরা পূজা শুরু করি। যে দেব দেবীকেই আমরা পূজা করি তিনি এই সর্বভূতে বিরাজমান – এই হয় আমাদের স্তুতি বাক্য। অনেক ক্ষেত্রে এই প্রাণকে তথা মহাপ্রাণকে 'পুরুষ' বলা হয়েছে। পুরুষ ও প্রকৃতি দুটি পৃথক সত্তা মনে হলেও – এই দুই কখনোই দুটি পৃথক সত্তা নয়। তাই তো শিবের 'অর্ধনারীশ্বর' মূর্তির কল্পনা করা হয়েছে। পুরুষ ও প্রকৃতি, এই দুটি সত্তা পৃথক রূপে অবস্থান করছেন; পুরুষ-প্রকৃতি এই অবস্থান কিন্তু অনাদি কালের  নয়। প্রকৃতির এই অবস্থান পুরুষের প্রয়োজনেই। কার্যের যেমন কারণে লয় হয়, নির্দিষ্ট সময়ের অন্তে (কল্পান্তে) প্রকৃতি পুরুষে লীন হন। পুরুষ তথা পরমাত্মা মায়ার মধ্যে দিয়ে এই প্রকৃতি রচনা করেছেন। তাই পুরুষ ও প্রকৃতি দুটি পৃথক সত্তা নয়। জীবাত্মার ক্ষেত্রে তাই দেখা যায় এক প্রাণ যা সেই অনন্ত প্রাণের এক অপূর্ণ প্রকাশ; মন যা মায়া রূপে সেই প্রাণকে নানা কর্ম বাসনায় লিপ্ত রাখে এবং তনু বা এই স্হূল শরীর যার মাধ্যমে নানা কর্ম সম্পাদিত হয়।
যে জড় জগৎ আমরা দেখি , তাই তা হল পুরুষ তথা প্রাণেরই মায়ারূপ প্রকাশ, যা অনিত্য। কারণের অপসারণে যার লয় অবস্যম্ভাবী। মহাপ্রাণরূপ পরম কারণে তাই মায়ার প্রকাশ রূপ যেকোন সৃষ্টিকেই  লয় পেতে হয় কালের চক্রে।
তাই এ বিশ্ব চরাচরে একটি মাত্র সত্তাই বর্তমান যাকে আমরা নানা রূপে দেখে থাকি। যত দ্বৈত সত্তা আমরা দেখি তা আমাদের ইন্দ্রিয়ের সাপেক্ষে। অজ্ঞান দূর হলে ইন্দ্রিয় আর রজ্জুতে সর্প দর্শণ করে না। সর্বভূতে, সমস্ত জীবে অনন্ত প্রাণ রূপ একই সত্তাকে দর্শণ করে।

মঙ্গলবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৭

চৈতন্য

চৈতন্য তথা চেতনা কি? বুদ্ধি ও চৈতন্য কি এক? আমরা এর উত্তর অন্বেষণের চেষ্টা করব। বুদ্ধি নির্ণয় করে কি করা উচিৎ এবং কোনটা করা উচিৎ নয়। বুদ্ধি আমাদের যুক্তি কপাটিকার মাধ্যমে নিজের সিদ্ধান্ত জানায়। অপর পক্ষে চেতনা তথা চৈতন্য আমাদের মনের অনুভূতির সৃষ্টি করে। আমরা অনুভব করতে পারি (we can feel) এবং এটি সতস্ফুর্ত। এর জন্য কোন চিন্তার প্রয়োজন হয় না। চৈতন্য এ ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি বিন্দুতে বর্তমান। অর্থাৎ এই ব্রহ্মাণ্ড চৈতন্যময়। বিষয়টি বোঝার জন্য আমরা একটা টান করা রবারের পর্দার উদাহরণ নিতে পারি বা ঢাকের চামড়ার উদাহরণ নিতে পারি। চামড়া বা রবারের পর্দার কোন এক বিন্দুতে একটু টোকা মারলে বা আঁচড় কাটলে পর্দার সমস্ত অংশেই ঐ টোকা বা আঁচড়ের প্রভাব দেখা যায়। এ বিশ্বকে আমরা ঐ টান করা রবারের চাদরের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। এ ব্রহ্মাণ্ডের যেকোন বিন্দুতে সৃষ্ট সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর যেকোন আলোড়নই টান করা চাদরের মতো বিশ্বের প্রতিটি কোনায় তার প্রভাব বিস্তার করে। চেতনা তথা চৈতন্য হল ঐ টান করা চাদর যা বিশ্বব্যাপী অখণ্ডভাবে বিরজমান। আমরা প্রত্যেকেই কম বেশি এই চৈতন্য স্বরূপার এক এক প্রকাশ অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণ চেতনা শক্তির অধিকারী। 
ঈশক্রিয়া হল এই টান করা চাদরের উপর এক একটি টোকা যা বিশ্বব্যাপী তার প্রভাব বিস্তার করে। বলা হয়েছে এই বিশ্বের প্রতিটি ঘটনা অপর কোন ঘটনার সাথে কার্য-কারণ সম্পর্কে আবদ্ধ। অর্থাৎ সমস্ত ঘটনাবলী অনেকাংশে পূর্ব নির্ধারিত এবং সমস্ত ঘটনাবলীই অনেকাংশে পূর্বাভাস যোগ্য। এখানে 'অনেকাংশে' বলার কারণ ঈশক্রিয়া। ঈশিক্রিয়াই কোন ঘটনাকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। তবে আমরা যাকে ঈশক্রিয়া বলছি অর্থাৎ স্বপ্রনদিত কার্য (কারণ বিহীন)  তাও অপর কোন সূক্ষ্মতর কারণের কার্য। অর্থাৎ সমস্ত ঈশক্রিয়াই হল কোন এক পরম ইচ্ছার সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত। 
তবে এ বিশ্ব অবশ্যই দ্বিমাত্রিক নয়। তাই টান করা চাদরের উদাহরণ কেবল উপমা মাত্র। যে উপমাই আমরা গ্রহণ করি না কেন - বিশ্বের যেকোন প্রান্তে ঘটে যাওয়া সূক্ষ্মতম আলোড়নও বিশ্বব্যাপী তার প্রভাব বিস্তার করে। বিশ্বব্যাপী বিরাজমান এই গুণাতীত সত্তাকেই আমরা স্বয়ং চৈতন্য স্বরূপা বলছি যা তরঙ্গবৎ সর্বব্যাপী বিদ্যমান। চৌম্বক বলরেখা যেমন কোন পদার্থের উপস্থিতির দ্বারা প্রভাবিত হয় - যেকোন সামান্য ভরও বিশ্বব্যাপী চৌম্বক আবেশরেখা তথা বলরেখার আকৃতিকে পরিবর্তন করতে পারে - তেমনই চৈতন্য স্বরূপা এই নির্গুণ সত্তাও যেকোন শুভাশুভ কর্মের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী প্রভাবিত হয়। যে প্রাণী যত বেশী এইরূপ চেতনাশক্তির অধিকারী তাকে তত বেশী চেতন যুক্ত আমরা বলে থাকি। আমরা এই চেতনা শক্তিকে বিশ্বব্যাপী তরঙ্গবৎ বিরাজমান বলে গ্রহণ করেছি। এটাই আমাদের স্বিকার্য। এই স্বিকার্যের সাহায্যেই আমরা পরবর্তীতে এই বিশ্বের নানা ঘটনাবলীকে ব্যাখ্যা করতে সমর্থ্য হব। 
অনুসিদ্ধান্তঃ
--> চৌম্বক আবেশ রেখার ন্যায় বিশ্বব্যাপী চৈতন্য যেকোন শুভাশুভ কর্মের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী প্রভানিত হয়। যেমন করে কোন তন্ত্রে (system-এ) ঘটে যাওয়া যেকোন সূক্ষ্মতম শুভাশুভ কর্মও সমগ্র system বা তন্ত্রের উপর প্রভাব ফেলে।
--> তুমি হাসলে আমিও হাসি, তুমি কাঁদলে আমিও দুঃখ পাই, তুমি যখন আনন্দে উচ্ছল হয়ে ওঠো তা আমাকেও নাড়া দেয়। তরঙ্গবৎ চৈতন্যশক্তির অনুনাদই এর কারণ। 
--> ঈশক্রিয়া রূপে এই তরঙ্গের স্রষ্টা স্বয়ং প্রাণ, প্রতিটি প্রাণী তথা চেতনে যার প্রকাশ।