রবিবার, ৮ মে, ২০১৬

আমি অসহিষ্ণু




আমি অসহিষ্ণু

প্রথমেই প্রতিবাদ জানাই দেশের নানা প্রান্তে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী যা মানবতার ন্যূনতম মূল্যবোধকে কলঙ্কিত করে। পাকিস্তানের পূর্বতন বিদেশ মন্ত্রী খুর্শিদ মাহমুদ কাসুরির লেখা বই "Neither a Hock Nor a Dove” এর মুম্বাই উদ্বোধনে আয়োজক সুধিন্দ্র কুলকার্ণিকে কালি মাখানোর ঘটনা - সবাই যে ছবি দেখেছেন - অটি বড় শত্রুর সাথেও এরকম ব্যবহার কোন সুসভ্যতার লক্ষণ নয়। এরপর গো হত্যা, গো মাংস ভক্ষণ ইত্যাদি এবং ইত্যাদি। প্রতিক্রিয়ায় দেশের নানা বিদ্বজ্জনদের প্রাপ্ত পুরষ্কার প্রত্যাখ্যান। একশ কুড়ি কোটি মানুষের দেশ ভারতবর্ষে প্রতিটি মানুষ সুখে শান্তিতে স্বধর্ম রক্ষা করে জীবন নির্বাহ করবেন - এটাই কাম্য। হিন্দু সংখ্যা গরিষ্ঠের দেশ ভারতবর্ষ হলেও আরও নানা ধর্ম এই দেশে লালিত ও পালিত। যে কোন জাতির একটা নির্দিষ্ট অভিলক্ষ্য থাকে। দেশের মানুষের ধর্ম-সংস্কৃতি এই অভিলক্ক্যকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে। "সত্যমেব জয়তে" আমাদের জাতিয় উদ্ধৃতি। সত্যের পথে চলার লক্ষ্যে বহু প্রাচীন আমাদের এই সভ্যতা যেমন আমাদের দিয়েছেন বেদান্ত, ভাগবত, তেমনই সত্যের পথে অবিচল থাকার লক্ষ্যে সত্যের পরীক্ষায় স্থান দিয়েছেন আরও নানা মত ও পথের। চার্বাকের মতো নিরীশ্বরবাদীরাও স্থান পেয়েছে আমাদের এই সভ্যতায়। সত্যের মঙ্গল ঘট পূর্ণ করার লক্ষ্যে 'সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থ নীড়ে' জড়ো হয়েছই আমরা সবাই। সহস্রাব্দ প্রাচীন এই হিন্দু জাতি - বেদান্ত তথা উপনিষদই যাদের ধর্মের মূল ভিত্তি - তাঁদের সামনে এখন ধর্ম রক্ষার লড়াই। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে মানুষের দোদূল্যমানতা - কোনটা সঠিক? ত্যাগ না ভোগ। একদিকে নতুন নতুন সৃষ্টি, আকর্ষণ, নানা হাতছানি - 'আমাকে ওর আগে যেতেই হবে' - 'আমার ওটা পেতেই হবে' - আপর দিকে 'সংগচ্ছদ্ধম সংবদাদ্ধম সংবোমানমসি জানতম' - এক সাথে চলব, এক কথা বলব, একই চিন্তা করব। - ত্যাগেই মুক্তি। কে কি খাবে, কে কি পরবে, কে কি দেখবে - এক কথায় এটা 'ব্যক্তিগত পছন্দ' বলে দিলেই সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। কারণ ব্যক্তির আচরণের উপর তার সামাজিক প্রভাব বর্তমান। সুতরাং তোমার সমস্ত কর্মকান্ডই সমাজে তার প্রভাব ফেলবে। তাহলে? যে মানুষটা গো ভক্ষণ করেছে তাকে মারধোর কর? যে গো হত্যা করেছে তাকেও হত্যা কর?

হ্যাঁ, আমি অসহিষ্ণু। যে দেশ (পাকিস্তান) প্রত্যহ কোন না কোন ভাবে আমাদের সাথে মিথ্যাচনে লিপ্ত, তাদের প্রতি সহ্যের একটা সীমা আছে। কিন্তু কারও গায়ে কালি মাখিয়ে এই অসহিষ্ণুতা! আমি গো হত্যা এবং গো ভক্ষণের বিরোধী। কিন্তু গো হত্যাকারীকে হত্যা করলেই কি আমরা গো মাতার আশীর্বাদ ধন্য হব? মানবতার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে?

হ্যাঁ, হিংস্রতা কোন সমাধান হতে পারে না। জাতীয়তাবাদ যদি উগ্র হয়, তাহলে তা জাতির মঙ্গল সাধন করে না। 'রাষ্ট্রীয় স্বয়ম সেবক সঙ্ঘ' তার উচ্চ আদর্শ, মূল্যবোধ ও জাতীয়তাবোধের জন্য গর্বিত। কিন্তু 'হিংস্রতা!' - এ কোন মূল্যবোধের নিদর্শণ। হয়ত বা তারা এই হিংস্রতার সাথে যুক্ত নন। কিন্তু অসহিষ্ণুতার প্রশ্নে তাঁদের এগিয়ে আসতেই হবে তাঁদের আদর্শ, মূল্যবোধ ও দেশভক্তি নিয়ে। দেশের প্রতি ভালোবাসা যদি তাদের একটুও থাকে। জাতীয়তাবাদ যেন উগ্রতায় পরিণত না হয়। হ্যাঁ, বেদই আমাদের জাতিয় ধারা। আমাদের সভ্যতা সংস্কৃতির মূল সূত্র। আমরা প্রতিটা ভারতবাসী আমাদের শোণিতে (রক্তে) সহস্র বছর ধরে এই ধারা বহন করে চলেছি। তার সাথে এটাও ভুললে চলবে না যে এদেশে জন সংখ্যার একটা বর অংশ মুসলমান। আর তারা এদেশের বাইরে থেকে ভারতবর্ষে আসেননি। আমাদের কর্মকাণ্ড যেন মানবতার সীমাকে লঙ্ঘন না করে, যে মানবতার শিক্ষা ধর্মই আমাদের দিয়েছেন। নিজের ধর্ম তথা অস্তিত্ব রক্ষার জন্য উগ্রতার প্রয়োজন হয় না - প্রয়োজন আত্মজ্ঞানের। যে আত্মজ্ঞান আমাদের মুনি ঋষিরা পেয়েছিলেন। আমরা তাঁদেরই উত্তরসূরিরা আজ সেই জ্ঞান বিস্মৃত। বেদের মর্ম বাণী যা সত্যকেই প্রতিধ্বনিত করে - আমরা চেষ্টা করে দেখি না - সত্যের পথে চলা যায় কিনা। আজকে ভারতবর্ষ বিশ্ব সমীক্ষা অনুযায়ী সর্বাধিক ভ্রষ্টাচারী (corrupt) দেশ গুলির মধ্যে অন্যতম। সমস্যার মূল কিন্তু এক যায়গায় - অসহিষ্ণুতা। এই অসহিষ্ণুতাই আমাদের সত্য থেকে দূরে নিয়ে গেছে। সত্যের পথ সুগম নয়। একটু বাধা পেলেই অসত্যের আশ্রয় নেওয়া - এ তো অসহিষ্ণুতারই বীজ। যে বীজ স্বাধীনতার জন্ম লগ্ন থেকে এবং তারও পূর্ববর্তি সময় থেকে আমরা বপন করে এসেছি। আমাদের আনন্দিত হবার কোন কারণ নেই - যে আমি অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে সোচ্চার, সেও এই একই পথের পথিক। তাই একটু চেষ্টা করে দেখি না সত্যের পথে চলা যায় কিনা। অসহিষ্ণুতার ভার আমাদের বহন করতে হবে না। আমরা মুক্ত হব। কাউকে পরাস্ত করা সম্ভব নয়, যদি না সে নিজে থেকে পরাজয়কে মেনে নেয়। তাই নিজে না চাইলে সত্যের পথ থেকে চ্যুত হওয়াও সম্ভব নয়। আর ভুলই শিক্ষা দেয় ভবিষ্যতে সফল হবার।

মঙ্গলবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৬



আমি অসহিষ্ণু


প্রথমেই প্রতিবাদ জানাই দেশের নানা প্রান্তে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী যা মানবতার ন্যূনতম মূল্যবোধকে কলঙ্কিত করে। পাকিস্তানের পূর্বতন বিদেশ মন্ত্রী খুর্শিদ মাহমুদ কাসুরির লেখা বই "Neither a Hock Nor a Dove” এর মুম্বাই উদ্বোধনে আয়োজক সুধিন্দ্র কুলকার্ণিকে কালি মাখানোর ঘটনা - সবাই যে ছবি দেখেছেন - অটি বড় শত্রুর সাথেও এরকম ব্যবহার কোন সুসভ্যতার লক্ষণ নয়। এরপর গো হত্যা, গো মাংস ভক্ষণ ইত্যাদি এবং ইত্যাদি। প্রতিক্রিয়ায় দেশের নানা বিদ্বজ্জনদের প্রাপ্ত পুরষ্কার প্রত্যাখ্যান। একশ কুড়ি কোটি মানুষের দেশ ভারতবর্ষে প্রতিটি মানুষ সুখে শান্তিতে স্বধর্ম রক্ষা করে জীবন নির্বাহ করবেন - এটাই কাম্য। হিন্দু সংখ্যা গরিষ্ঠের দেশ ভারতবর্ষ হলেও আরও নানা ধর্ম এই দেশে লালিত ও পালিত। যে কোন জাতির একটা নির্দিষ্ট অভিলক্ষ্য থাকে। দেশের মানুষের ধর্ম-সংস্কৃতি এই অভিলক্ক্যকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে। "সত্যমেব জয়তে" আমাদের জাতিয় উদ্ধৃতি। সত্যের পথে চলার লক্ষ্যে বহু প্রাচীন আমাদের এই সভ্যতা যেমন আমাদের দিয়েছেন বেদান্ত, ভাগবত, তেমনই সত্যের পথে অবিচল থাকার লক্ষ্যে সত্যের পরীক্ষায় স্থান দিয়েছেন আরও নানা মত ও পথের। চার্বাকের মতো নিরীশ্বরবাদীরাও স্থান পেয়েছে আমাদের এই সভ্যতায়। সত্যের মঙ্গল ঘট পূর্ণ করার লক্ষ্যে 'সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থ নীড়ে' জড়ো হয়েছই আমরা সবাই। সহস্রাব্দ প্রাচীন এই হিন্দু জাতি - বেদান্ত তথা উপনিষদই যাদের ধর্মের মূল ভিত্তি - তাঁদের সামনে এখন ধর্ম রক্ষার লড়াই। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে মানুষের দোদূল্যমানতা - কোনটা সঠিক? ত্যাগ না ভোগ। একদিকে নতুন নতুন সৃষ্টি, আকর্ষণ, নানা হাতছানি - 'আমাকে ওর আগে যেতেই হবে' - 'আমার ওটা পেতেই হবে' - আপর দিকে 'সংগচ্ছদ্ধম সংবদাদ্ধম সংবোমানমসি জানতম' - এক সাথে চলব, এক কথা বলব, একই চিন্তা করব। - ত্যাগেই মুক্তি। কে কি খাবে, কে কি পরবে, কে কি দেখবে - এক কথায় এটা 'ব্যক্তিগত পছন্দ' বলে দিলেই সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। কারণ ব্যক্তির আচরণের উপর তার সামাজিক প্রভাব বর্তমান। সুতরাং তোমার সমস্ত কর্মকান্ডই সমাজে তার প্রভাব ফেলবে। তাহলে? যে মানুষটা গো ভক্ষণ করেছে তাকে মারধোর কর? যে গো হত্যা করেছে তাকেও হত্যা কর?

হ্যাঁ, আমি অসহিষ্ণু। যে দেশ (পাকিস্তান) প্রত্যহ কোন না কোন ভাবে আমাদের সাথে মিথ্যাচনে লিপ্ত, তাদের প্রতি সহ্যের একটা সীমা আছে। কিন্তু কারও গায়ে কালি মাখিয়ে এই অসহিষ্ণুতা! আমি গো হত্যা এবং গো ভক্ষণের বিরোধী। কিন্তু গো হত্যাকারীকে হত্যা করলেই কি আমরা গো মাতার আশীর্বাদ ধন্য হব? মানবতার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে?

হ্যাঁ, হিংস্রতা কোন সমাধান হতে পারে না। জাতীয়তাবাদ যদি উগ্র হয়, তাহলে তা জাতির মঙ্গল সাধন করে না। 'রাষ্ট্রীয় স্বয়ম সেবক সঙ্ঘ' তার উচ্চ আদর্শ, মূল্যবোধ ও জাতীয়তাবোধের জন্য গর্বিত। কিন্তু 'হিংস্রতা!' - এ কোন মূল্যবোধের নিদর্শণ। হয়ত বা তারা এই হিংস্রতার সাথে যুক্ত নন। কিন্তু অসহিষ্ণুতার প্রশ্নে তাঁদের এগিয়ে আসতেই হবে তাঁদের আদর্শ, মূল্যবোধ ও দেশভক্তি নিয়ে। দেশের প্রতি ভালোবাসা যদি তাদের একটুও থাকে। জাতীয়তাবাদ যেন উগ্রতায় পরিণত না হয়। হ্যাঁ, বেদই আমাদের জাতিয় ধারা। আমাদের সভ্যতা সংস্কৃতির মূল সূত্র। আমরা প্রতিটা ভারতবাসী আমাদের শোণিতে (রক্তে) সহস্র বছর ধরে এই ধারা বহন করে চলেছি। তার সাথে এটাও ভুললে চলবে না যে এদেশে জন সংখ্যার একটা বর অংশ মুসলমান। আর তারা এদেশের বাইরে থেকে ভারতবর্ষে আসেননি। আমাদের কর্মকাণ্ড যেন মানবতার সীমাকে লঙ্ঘন না করে, যে মানবতার শিক্ষা ধর্মই আমাদের দিয়েছেন। নিজের ধর্ম তথা অস্তিত্ব রক্ষার জন্য উগ্রতার প্রয়োজন হয় না - প্রয়োজন আত্মজ্ঞানের। যে আত্মজ্ঞান আমাদের মুনি ঋষিরা পেয়েছিলেন। আমরা তাঁদেরই উত্তরসূরিরা আজ সেই জ্ঞান বিস্মৃত। বেদের মর্ম বাণী যা সত্যকেই প্রতিধ্বনিত করে - আমরা চেষ্টা করে দেখি না - সত্যের পথে চলা যায় কিনা। আজকে ভারতবর্ষ বিশ্ব সমীক্ষা অনুযায়ী সর্বাধিক ভ্রষ্টাচারী (corrupt) দেশ গুলির মধ্যে অন্যতম। সমস্যার মূল কিন্তু এক যায়গায় - অসহিষ্ণুতা। এই অসহিষ্ণুতাই আমাদের সত্য থেকে দূরে নিয়ে গেছে। সত্যের পথ সুগম নয়। একটু বাধা পেলেই অসত্যের আশ্রয় নেওয়া - এ তো অসহিষ্ণুতারই বীজ। যে বীজ স্বাধীনতার জন্ম লগ্ন থেকে এবং তারও পূর্ববর্তি সময় থেকে আমরা বপন করে এসেছি। আমাদের আনন্দিত হবার কোন কারণ নেই - যে আমি অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে সোচ্চার, সেও এই একই পথের পথিক। তাই একটু চেষ্টা করে দেখি না সত্যের পথে চলা যায় কিনা। অসহিষ্ণুতার ভার আমাদের বহন করতে হবে না। আমরা মুক্ত হব। কাউকে পরাস্ত করা সম্ভব নয়, যদি না সে নিজে থেকে পরাজয়কে মেনে নেয়। তাই নিজে না চাইলে সত্যের পথ থেকে চ্যুত হওয়াও সম্ভব নয়। আর ভুলই শিক্ষা দেয় ভবিষ্যতে সফল হবার।

বুধবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৬

পরা-অপরা


পরা-অপরা



যে জ্ঞান আমাদের বাইরের জগতের সঙ্গে আমাদের পরিচিত করায় - তাই অপরা। আর যে জ্ঞান আমাদের পরম সত্যের দিশা দেয় তা হল পরা বিদ্যা। ভারতীয় শাস্ত্রে আত্মা তথা পরমাত্মাই হলেন পরম সত্য। তাই পরমাত্মাকে জানার জ্ঞানই হল পরা বিদ্যা। অর্থাৎ অধ্যাত্মবাদ তথা অধিবিদ্যাকেই বলা হয় পরা বিদ্যা। পরা অর্থ শ্রেষ্ঠা তথা উচ্চ এবং অপরা অর্থ নিম্ন। অনেক ক্ষেত্রে এই উচ্চ বা পরা বিদ্যাকে শুধু মাত্র বিদ্যা বলেই অভিহিত করা হয়েছে। অপর পক্ষে অবিদ্যা শাস্ত্র হল অপরা বিদ্যা। আমাদের বাস্তব জগতের জ্ঞানকে এই অবিদ্যা বা অপরা বিদ্যা বলে অভিহিত করা হয়। বাস্তব জগতের জ্ঞান যথা পদার্থ বিদ্যা থেকে স্থাপত্য বিদ্যা, কলা, সংগীত - যা কিছু এই মায়াময় জগতে মায়ার বিকাশের সহায়ক সবই এই অপরা বিদ্যা বা অবিদ্যা শাস্ত্রের অন্তর্গত। প্রাচীন ভারতবর্ষে বিদ্যা তথা পরা বিদ্যার সাথে সাথে অপরা বিদ্যা তথা অবিদ্যা শাস্ত্রও বিকশিত হয়েছিল। দিল্লীর কুতুবশাহি কমপ্লেক্সে রক্ষিত গুপ্তযুগের মরিচা বিহীন লোহার স্তম্ভ, প্রাচীন সোমনাথ মন্দিরের ঝুলন্ত বিগ্রহ( যা সবুক্তগিন ধ্বংস করেছিলেন) - সবই প্রাচীন ভারতে অপরা বিদ্যার অভূতপূর্ব নিদর্শনের সাক্ষী। আমাদের উপনিষদে পরা বিদ্যাকে যেমন পরম জ্ঞান লাভের উপায় রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে তেমনই অপরা বিদ্যাকে জাগতিক উন্নতি তথা বিকাশের সহায়ক রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। জগতের বিকাশের জন্য উভয় বিদ্যাই সমান ভাবে প্রয়োজনীয়। তাই আমাদের মাণ্ডুক্য উপনিষদে বলা হয়েছে "দ্বে বিদ্যে বেদিতব্যে পরা চাপরা "

নির্গুণ এবং সগুণ




নির্গুণ এবং সগুণ

ঈশ্বরবাদী এবং বিজ্ঞানবাদী উভয়ের কাছেই নির্গুণ ও সগুণের ধারনা স্পষ্ট হওয়া দরকার। আমাদের প্রশ্ন – সৃষ্টির আদিতে কি ছিল, অন্তেই বা কি, কিভাবে প্রাণের সৃষ্টি হল – ইত্যাদি। নির্গুণ - অর্থ নাই গুণ অর্থাৎ গুণহীন অবস্থা। সগুণ অর্থাৎ গুণযুক্ত অবস্থা। ঈশ্বরবাদী ও বিজ্ঞানবাদী উভয়েই এ বিষয়ে একমত যে শুরুতে কিছুই ছিল না। এই বিশ্ব – এই জগৎ সৃষ্টি পরে হয়েছে। আগে সৃষ্টি তারপর গুণারোপ। অর্থাৎ কোন কিছু সৃষ্টির পরেই তাতে নানা রকম গুণ আরোপ করা যেতে পারে। তাই গুণ বস্তুর মৌলিক ধর্ম নয়। গুণ যেমন অর্জন করা যেতে পারে তেমনই তা ক্ষয়শীল। চিরস্থায়ী তাই’ই – যা শুরুতে ছিল, এখনও আছে, শেষেও থাকবে। চিরস্থায়ী যে কোন কিছুই হল নির্গুণ অবস্থা – যা অর্জিত হয় নাই, যা সততই বিদ্যমান, যার কোন ক্ষয় নাই – তাই’ই নির্গুণ অবস্থা। এই অবস্থাকে গুণাতীত অবস্থাও বলা হয়। আর সগুণ অবস্থা নির্গুণের অনুবর্তী।

নির্গুণ ও সগুণ – আরও স্পষ্ট করে বুঝতে গেলে কতকগুলি উদাহরণের সাহায্য নেওয়া যেতেই পারে – ধরা যাক আমাদের সামনে একটি কাঠের চেয়ার রয়েছে। চেয়ারটিতে দুপাশে হাত রাখার জায়গা আছে। সুন্দর হেলান দেবার ব্যবস্থা আছে। এগুলি হল চেয়ারটির গুণ। কিন্তু শুরুতে এগুলি ছিল না।শুরুতে ছিল শুধুই কাঠ, কতকগুলি কাঠকে জোড়া লাগিয়েই একটা চেয়ার তৈরি করা হয়েছে। দেওয়া হয়েছে ‘বসা যায়’ এমন এক প্রাথমিক গুণ। তারপর তাতে আরও গুণ অর্পণ করা হয়েছে – তৈরি হয়েছে একপ্রকার আরাম কেদারা। আবার চেয়ারের শুরুতে যে কাঠ – তার যা যা গুণাবলি – তাও প্রথমে ছিল না। প্রাথমিক অবস্থায় কাঠটি কাঁচা ছিল, তারও আগে কাঠের টুকরোগুলি কোন গাছের গুঁড়ির অংশ ছিল। গাছের গুড়ি থেকে কাঠের টুকরোটি কেটে বার করতে হয়েছে – সাথে সাথে গুণারোপ হয়েছে কাঠের টুকরোটির। এইভাবে আমরা যত প্রাথমিক থেকে প্রাথমিকতর স্তরে যাবো তত আমরা বস্তুর মৌলিকতর অবস্থা প্রাপ্ত হব। বস্তুর যত মৌলিকতর অবস্থা প্রাপ্ত হব তত সেখানে গুণের অস্তিত্ব কম প্রকাশমান হবে। অবশেষে আরও প্রাথমিক স্তরে আমরা দেখবো(!) বস্তুটির অস্তিত্বই সঙ্কটে পড়ে যাচ্ছে। অবশেষে হয়ত আমরা গুণযুক্ত কিছুই খুঁজে পাব না। - এই হল ঐ চেয়ারের পূর্ণ নির্গুণ অবস্থা। আমাদের চারিপাশে যা কিছু আমরা দেখি – ঘর-বাড়ি, জামা-কাপড়, খাদ্য-পানীয়, ভোগ্য বস্তু এমনকি আমরা নিজেরা পর্যন্ত – সমস্ত কিছুরই এই একই অবস্থা। প্রথমে কাঁচা মাল – তারপরে রূপদান – তারপরে গুণ প্রদান। আবার সেই কাঁচা মালের গুণাবলীও আরোপিত হয়েছে আরও মৌলিক কোন স্বল্প গুণযুক্ত বস্তু হতে। একদম প্রাথমিক স্তরে সেই নির্গুণ অবস্থা। এই ভাবে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের যা কিছু – নানা গুণের অধিকারী শস্য-শ্যামলা পৃথিবী থেকে শুরু করে – অন্যান্য গ্রহ-তারা-সূর্য – সবারই এই এক আদি বা এক পরিণতি – নির্গুণ অবস্থা – যা কোন দিন অর্জিত হয় নাই, তার কোন ক্ষয়ও নাই। সমস্ত সৃষ্টির মূলে সেই নির্গুণ। আচ্ছা নির্গুণ-সগুণ ধারনা না হয় প্রাথমিক ভাবে বোঝা গেল। কিন্তু অবস্থা কী বা তার বৈশিষ্ট্য কী বা যদি সম্পূর্ণ গুণহীন অবস্থা হয় – কী তার সত্ত্বা? আবার বৈশিষ্ট্য থাকলেই গুণের প্রশ্ন এসে যায়। তবে কী আছে সেই অবস্থায়? আমাদের প্রশ্ন সেখানেই, আমাদের গবেষণাও সেই নিয়েই। তবে প্রাথমিকভাবে বলা যায়, যাকে অমরা নির্গুণ বলছি তা শুধুই এই মায়াময় জগতের সাপেক্ষেই। নির্গুণ অবস্থা হল সেই অবস্থা যেখানে জগতের কোন নিয়ম, কোন গুণ প্রযোজ্য নয় – মায়ার ঊর্ধ্বে। আবার পরে আমরা দেখব প্রাণী এবং অন্যান্য-জীব সম্বন্ধে এই নির্গুণ-সগুণ ধারনার প্রয়োগ কিভাবে আমাদের বহু চর্চিত প্রশ্নের সমাধানের দিকে নিয়ে যায়।

দ্বৈত বাদীর ভাষায় নির্গুণ সত্ত্বা অসম্ভব। তাঁদের কথায় ব্রহ্ম সগুণ – ব্রহ্ম কখনও নির্গুণ হতে পারেন না – কারণ শূন্য থেকে কোন কিছুর সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব। এইখানেই ভ্রান্তি এবং দ্বন্দ্ব। তাঁরা যে গুণহীন অবস্থাকে শূন্য বলছেন তা প্রকৃত-রূপে গুণাতীত অবস্থা। অক্ষয়-অব্যয়,নিত্য এই অবস্থাকেই অদ্বৈতবাদী নির্গুণ ব্রহ্ম বলেন। নির্গুণ ব্রহ্মের এই গুণাতীত অবস্থায় যেকোনো রকম গুণই অব্যক্ত।