বুধবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৬

নির্গুণ এবং সগুণ




নির্গুণ এবং সগুণ

ঈশ্বরবাদী এবং বিজ্ঞানবাদী উভয়ের কাছেই নির্গুণ ও সগুণের ধারনা স্পষ্ট হওয়া দরকার। আমাদের প্রশ্ন – সৃষ্টির আদিতে কি ছিল, অন্তেই বা কি, কিভাবে প্রাণের সৃষ্টি হল – ইত্যাদি। নির্গুণ - অর্থ নাই গুণ অর্থাৎ গুণহীন অবস্থা। সগুণ অর্থাৎ গুণযুক্ত অবস্থা। ঈশ্বরবাদী ও বিজ্ঞানবাদী উভয়েই এ বিষয়ে একমত যে শুরুতে কিছুই ছিল না। এই বিশ্ব – এই জগৎ সৃষ্টি পরে হয়েছে। আগে সৃষ্টি তারপর গুণারোপ। অর্থাৎ কোন কিছু সৃষ্টির পরেই তাতে নানা রকম গুণ আরোপ করা যেতে পারে। তাই গুণ বস্তুর মৌলিক ধর্ম নয়। গুণ যেমন অর্জন করা যেতে পারে তেমনই তা ক্ষয়শীল। চিরস্থায়ী তাই’ই – যা শুরুতে ছিল, এখনও আছে, শেষেও থাকবে। চিরস্থায়ী যে কোন কিছুই হল নির্গুণ অবস্থা – যা অর্জিত হয় নাই, যা সততই বিদ্যমান, যার কোন ক্ষয় নাই – তাই’ই নির্গুণ অবস্থা। এই অবস্থাকে গুণাতীত অবস্থাও বলা হয়। আর সগুণ অবস্থা নির্গুণের অনুবর্তী।

নির্গুণ ও সগুণ – আরও স্পষ্ট করে বুঝতে গেলে কতকগুলি উদাহরণের সাহায্য নেওয়া যেতেই পারে – ধরা যাক আমাদের সামনে একটি কাঠের চেয়ার রয়েছে। চেয়ারটিতে দুপাশে হাত রাখার জায়গা আছে। সুন্দর হেলান দেবার ব্যবস্থা আছে। এগুলি হল চেয়ারটির গুণ। কিন্তু শুরুতে এগুলি ছিল না।শুরুতে ছিল শুধুই কাঠ, কতকগুলি কাঠকে জোড়া লাগিয়েই একটা চেয়ার তৈরি করা হয়েছে। দেওয়া হয়েছে ‘বসা যায়’ এমন এক প্রাথমিক গুণ। তারপর তাতে আরও গুণ অর্পণ করা হয়েছে – তৈরি হয়েছে একপ্রকার আরাম কেদারা। আবার চেয়ারের শুরুতে যে কাঠ – তার যা যা গুণাবলি – তাও প্রথমে ছিল না। প্রাথমিক অবস্থায় কাঠটি কাঁচা ছিল, তারও আগে কাঠের টুকরোগুলি কোন গাছের গুঁড়ির অংশ ছিল। গাছের গুড়ি থেকে কাঠের টুকরোটি কেটে বার করতে হয়েছে – সাথে সাথে গুণারোপ হয়েছে কাঠের টুকরোটির। এইভাবে আমরা যত প্রাথমিক থেকে প্রাথমিকতর স্তরে যাবো তত আমরা বস্তুর মৌলিকতর অবস্থা প্রাপ্ত হব। বস্তুর যত মৌলিকতর অবস্থা প্রাপ্ত হব তত সেখানে গুণের অস্তিত্ব কম প্রকাশমান হবে। অবশেষে আরও প্রাথমিক স্তরে আমরা দেখবো(!) বস্তুটির অস্তিত্বই সঙ্কটে পড়ে যাচ্ছে। অবশেষে হয়ত আমরা গুণযুক্ত কিছুই খুঁজে পাব না। - এই হল ঐ চেয়ারের পূর্ণ নির্গুণ অবস্থা। আমাদের চারিপাশে যা কিছু আমরা দেখি – ঘর-বাড়ি, জামা-কাপড়, খাদ্য-পানীয়, ভোগ্য বস্তু এমনকি আমরা নিজেরা পর্যন্ত – সমস্ত কিছুরই এই একই অবস্থা। প্রথমে কাঁচা মাল – তারপরে রূপদান – তারপরে গুণ প্রদান। আবার সেই কাঁচা মালের গুণাবলীও আরোপিত হয়েছে আরও মৌলিক কোন স্বল্প গুণযুক্ত বস্তু হতে। একদম প্রাথমিক স্তরে সেই নির্গুণ অবস্থা। এই ভাবে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের যা কিছু – নানা গুণের অধিকারী শস্য-শ্যামলা পৃথিবী থেকে শুরু করে – অন্যান্য গ্রহ-তারা-সূর্য – সবারই এই এক আদি বা এক পরিণতি – নির্গুণ অবস্থা – যা কোন দিন অর্জিত হয় নাই, তার কোন ক্ষয়ও নাই। সমস্ত সৃষ্টির মূলে সেই নির্গুণ। আচ্ছা নির্গুণ-সগুণ ধারনা না হয় প্রাথমিক ভাবে বোঝা গেল। কিন্তু অবস্থা কী বা তার বৈশিষ্ট্য কী বা যদি সম্পূর্ণ গুণহীন অবস্থা হয় – কী তার সত্ত্বা? আবার বৈশিষ্ট্য থাকলেই গুণের প্রশ্ন এসে যায়। তবে কী আছে সেই অবস্থায়? আমাদের প্রশ্ন সেখানেই, আমাদের গবেষণাও সেই নিয়েই। তবে প্রাথমিকভাবে বলা যায়, যাকে অমরা নির্গুণ বলছি তা শুধুই এই মায়াময় জগতের সাপেক্ষেই। নির্গুণ অবস্থা হল সেই অবস্থা যেখানে জগতের কোন নিয়ম, কোন গুণ প্রযোজ্য নয় – মায়ার ঊর্ধ্বে। আবার পরে আমরা দেখব প্রাণী এবং অন্যান্য-জীব সম্বন্ধে এই নির্গুণ-সগুণ ধারনার প্রয়োগ কিভাবে আমাদের বহু চর্চিত প্রশ্নের সমাধানের দিকে নিয়ে যায়।

দ্বৈত বাদীর ভাষায় নির্গুণ সত্ত্বা অসম্ভব। তাঁদের কথায় ব্রহ্ম সগুণ – ব্রহ্ম কখনও নির্গুণ হতে পারেন না – কারণ শূন্য থেকে কোন কিছুর সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব। এইখানেই ভ্রান্তি এবং দ্বন্দ্ব। তাঁরা যে গুণহীন অবস্থাকে শূন্য বলছেন তা প্রকৃত-রূপে গুণাতীত অবস্থা। অক্ষয়-অব্যয়,নিত্য এই অবস্থাকেই অদ্বৈতবাদী নির্গুণ ব্রহ্ম বলেন। নির্গুণ ব্রহ্মের এই গুণাতীত অবস্থায় যেকোনো রকম গুণই অব্যক্ত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন