রবিবার, ৮ মে, ২০১৬

আমি অসহিষ্ণু




আমি অসহিষ্ণু

প্রথমেই প্রতিবাদ জানাই দেশের নানা প্রান্তে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী যা মানবতার ন্যূনতম মূল্যবোধকে কলঙ্কিত করে। পাকিস্তানের পূর্বতন বিদেশ মন্ত্রী খুর্শিদ মাহমুদ কাসুরির লেখা বই "Neither a Hock Nor a Dove” এর মুম্বাই উদ্বোধনে আয়োজক সুধিন্দ্র কুলকার্ণিকে কালি মাখানোর ঘটনা - সবাই যে ছবি দেখেছেন - অটি বড় শত্রুর সাথেও এরকম ব্যবহার কোন সুসভ্যতার লক্ষণ নয়। এরপর গো হত্যা, গো মাংস ভক্ষণ ইত্যাদি এবং ইত্যাদি। প্রতিক্রিয়ায় দেশের নানা বিদ্বজ্জনদের প্রাপ্ত পুরষ্কার প্রত্যাখ্যান। একশ কুড়ি কোটি মানুষের দেশ ভারতবর্ষে প্রতিটি মানুষ সুখে শান্তিতে স্বধর্ম রক্ষা করে জীবন নির্বাহ করবেন - এটাই কাম্য। হিন্দু সংখ্যা গরিষ্ঠের দেশ ভারতবর্ষ হলেও আরও নানা ধর্ম এই দেশে লালিত ও পালিত। যে কোন জাতির একটা নির্দিষ্ট অভিলক্ষ্য থাকে। দেশের মানুষের ধর্ম-সংস্কৃতি এই অভিলক্ক্যকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে। "সত্যমেব জয়তে" আমাদের জাতিয় উদ্ধৃতি। সত্যের পথে চলার লক্ষ্যে বহু প্রাচীন আমাদের এই সভ্যতা যেমন আমাদের দিয়েছেন বেদান্ত, ভাগবত, তেমনই সত্যের পথে অবিচল থাকার লক্ষ্যে সত্যের পরীক্ষায় স্থান দিয়েছেন আরও নানা মত ও পথের। চার্বাকের মতো নিরীশ্বরবাদীরাও স্থান পেয়েছে আমাদের এই সভ্যতায়। সত্যের মঙ্গল ঘট পূর্ণ করার লক্ষ্যে 'সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থ নীড়ে' জড়ো হয়েছই আমরা সবাই। সহস্রাব্দ প্রাচীন এই হিন্দু জাতি - বেদান্ত তথা উপনিষদই যাদের ধর্মের মূল ভিত্তি - তাঁদের সামনে এখন ধর্ম রক্ষার লড়াই। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে মানুষের দোদূল্যমানতা - কোনটা সঠিক? ত্যাগ না ভোগ। একদিকে নতুন নতুন সৃষ্টি, আকর্ষণ, নানা হাতছানি - 'আমাকে ওর আগে যেতেই হবে' - 'আমার ওটা পেতেই হবে' - আপর দিকে 'সংগচ্ছদ্ধম সংবদাদ্ধম সংবোমানমসি জানতম' - এক সাথে চলব, এক কথা বলব, একই চিন্তা করব। - ত্যাগেই মুক্তি। কে কি খাবে, কে কি পরবে, কে কি দেখবে - এক কথায় এটা 'ব্যক্তিগত পছন্দ' বলে দিলেই সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। কারণ ব্যক্তির আচরণের উপর তার সামাজিক প্রভাব বর্তমান। সুতরাং তোমার সমস্ত কর্মকান্ডই সমাজে তার প্রভাব ফেলবে। তাহলে? যে মানুষটা গো ভক্ষণ করেছে তাকে মারধোর কর? যে গো হত্যা করেছে তাকেও হত্যা কর?

হ্যাঁ, আমি অসহিষ্ণু। যে দেশ (পাকিস্তান) প্রত্যহ কোন না কোন ভাবে আমাদের সাথে মিথ্যাচনে লিপ্ত, তাদের প্রতি সহ্যের একটা সীমা আছে। কিন্তু কারও গায়ে কালি মাখিয়ে এই অসহিষ্ণুতা! আমি গো হত্যা এবং গো ভক্ষণের বিরোধী। কিন্তু গো হত্যাকারীকে হত্যা করলেই কি আমরা গো মাতার আশীর্বাদ ধন্য হব? মানবতার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে?

হ্যাঁ, হিংস্রতা কোন সমাধান হতে পারে না। জাতীয়তাবাদ যদি উগ্র হয়, তাহলে তা জাতির মঙ্গল সাধন করে না। 'রাষ্ট্রীয় স্বয়ম সেবক সঙ্ঘ' তার উচ্চ আদর্শ, মূল্যবোধ ও জাতীয়তাবোধের জন্য গর্বিত। কিন্তু 'হিংস্রতা!' - এ কোন মূল্যবোধের নিদর্শণ। হয়ত বা তারা এই হিংস্রতার সাথে যুক্ত নন। কিন্তু অসহিষ্ণুতার প্রশ্নে তাঁদের এগিয়ে আসতেই হবে তাঁদের আদর্শ, মূল্যবোধ ও দেশভক্তি নিয়ে। দেশের প্রতি ভালোবাসা যদি তাদের একটুও থাকে। জাতীয়তাবাদ যেন উগ্রতায় পরিণত না হয়। হ্যাঁ, বেদই আমাদের জাতিয় ধারা। আমাদের সভ্যতা সংস্কৃতির মূল সূত্র। আমরা প্রতিটা ভারতবাসী আমাদের শোণিতে (রক্তে) সহস্র বছর ধরে এই ধারা বহন করে চলেছি। তার সাথে এটাও ভুললে চলবে না যে এদেশে জন সংখ্যার একটা বর অংশ মুসলমান। আর তারা এদেশের বাইরে থেকে ভারতবর্ষে আসেননি। আমাদের কর্মকাণ্ড যেন মানবতার সীমাকে লঙ্ঘন না করে, যে মানবতার শিক্ষা ধর্মই আমাদের দিয়েছেন। নিজের ধর্ম তথা অস্তিত্ব রক্ষার জন্য উগ্রতার প্রয়োজন হয় না - প্রয়োজন আত্মজ্ঞানের। যে আত্মজ্ঞান আমাদের মুনি ঋষিরা পেয়েছিলেন। আমরা তাঁদেরই উত্তরসূরিরা আজ সেই জ্ঞান বিস্মৃত। বেদের মর্ম বাণী যা সত্যকেই প্রতিধ্বনিত করে - আমরা চেষ্টা করে দেখি না - সত্যের পথে চলা যায় কিনা। আজকে ভারতবর্ষ বিশ্ব সমীক্ষা অনুযায়ী সর্বাধিক ভ্রষ্টাচারী (corrupt) দেশ গুলির মধ্যে অন্যতম। সমস্যার মূল কিন্তু এক যায়গায় - অসহিষ্ণুতা। এই অসহিষ্ণুতাই আমাদের সত্য থেকে দূরে নিয়ে গেছে। সত্যের পথ সুগম নয়। একটু বাধা পেলেই অসত্যের আশ্রয় নেওয়া - এ তো অসহিষ্ণুতারই বীজ। যে বীজ স্বাধীনতার জন্ম লগ্ন থেকে এবং তারও পূর্ববর্তি সময় থেকে আমরা বপন করে এসেছি। আমাদের আনন্দিত হবার কোন কারণ নেই - যে আমি অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে সোচ্চার, সেও এই একই পথের পথিক। তাই একটু চেষ্টা করে দেখি না সত্যের পথে চলা যায় কিনা। অসহিষ্ণুতার ভার আমাদের বহন করতে হবে না। আমরা মুক্ত হব। কাউকে পরাস্ত করা সম্ভব নয়, যদি না সে নিজে থেকে পরাজয়কে মেনে নেয়। তাই নিজে না চাইলে সত্যের পথ থেকে চ্যুত হওয়াও সম্ভব নয়। আর ভুলই শিক্ষা দেয় ভবিষ্যতে সফল হবার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন