রবিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১

 

অবতার তত্ত্ব

ঈশ্বর অবতার রূপে এই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন বিভিন্ন সময়ে। এই কথা ব্যক্ত হয়েছে নানা ধর্ম গ্রন্থে। শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন এই রকম অবতার। আবার যিশুখ্রিস্টকেও ঈশ্বরের অবতার তথা ঈশ্বর পুত্র বলা হয়। এই অবতার এবং নানা দেবদেবীর বিষয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের ধারনা অস্পষ্ট। নানা সময়ে আমরা নানা দেবদেবীর পূজার্চনা করি আবার একই সাথে শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরামকৃষ্ণ এঁদের পূজাও করে থাকি। একটা কথা আমাদের স্মরণে রাখতে হবে - পূজা আমরা যেকোন সত্তাকেই করতে পারি। পূজার মাধ্যমে কোন সত্তাকে তুষ্ট করতে পারলে আশানুরূপ ফল লাভ করা যায়। আমর আমাদের লৌকিক জগতে যেমনটি দেখি ঠিক তেমনটিই। কোন প্রভবশালী ব্যক্তির সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে আমরা যেমন তাঁর কৃপাধন্য হই; তার কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত কৃপা (সুযোগ বা সুবিধা) লাভ করি ঠিক তেমনই ভাবে কোন দেবদেবীকে তুষ্ট করে আমরা অনুরূপ ফল লাভ করি। এখন, পরম জ্ঞান লাভ করতে গেলে, পরমেশ্বরের সাক্ষাত লাভ করতে গেলে যেমন ভক্তি যোগের প্রয়োজন তেমন জ্ঞান যোগ তথা বিচার পথেও তাঁকে লভ করা যায়। তবে যে পথই আমরা গ্রহণ করি না কেন তাঁর কৃপা ছারা তাঁকে লাভ করা অসাধ্য। যে পথই গ্রহণ করা হোক না কেন সাধক যদি আন্তরিক হন তবে ভগবান নিজেই তাঁকে পথ দেখিয়ে দেন।

অবতার এবং দেবদেবীর পার্থক্য করতে গেলে প্রথমেই আমাদের জানতে হবে যে অবতার হলেন একজন ব্যক্তি যিনি এই পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছেন। মৃত্যুও তাঁর হবে এই জগতিক নিয়মেই। কিন্তু দেবত্ব হল নির্দিষ্ট কতক গুলি গুণ যা প্রকাশ পায় নানা ব্যক্তি তথা মানুষের মধ্যে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেবতা বলতে কোন সূক্ষ্ম শরীর ধারীকেই কল্পনা করা হয়েছে। আমাদের এই শরীর হল স্থূল। একে ধরা যায়, ছোঁয়া যায়, আঘাত করা যায়। সূক্ষ্ম শরীরকে কিন্তু ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না বা আঘাত করা যায় না। এই সূক্ষ্ম ও স্থূল শরীর বলতে আমরা কি বুঝবো। আমাদের এই শরীর হল স্থূল। এ আমাদের বোধগম্য। কিন্তু সূক্ষ্ম শরীর - তা কি? একথা প্রমাণিত - চৈতন্য সর্বব্যাপী। আর শক্তি প্রবাহের জন্য কোন মাধ্যমের প্রয়োজন হয় না। চৈতন্য রূপী যে বিশ্বব্যাপী কম্পন - নানা প্রকার সংস্কারের আবহে সে কম্পনের যে বদ্ধ প্রকাশ, তাই হল জীবাত্মা। কোন সূক্ষ্ম দেহ বলতে আমরা এইরূপ বদ্ধ চৈতন্য রূপ কম্পন রাশিকেই বুঝব। এই বদ্ধ চৈতন্য উপযুক্ত পরিবেশ পেলেই নিজেকে প্রকাশ করেন। তাই দেব দেবীরা কেউ মুক্ত নন। যাইহোক দেবদেবীরা তুষ্ট হলে তাঁরা তাঁদের ক্ষমতা অনুযায়ী অভীষ্ট ফল প্রদান করেন।

অপর পক্ষে অবতার কে? এখানে বলা প্রয়োজন পরম সত্য স্বরূপ পরমেশ্বর কিন্তু দেবদেবীদের মতো বদ্ধ চৈতন্য নন। তিনি মুক্ত, এক এবং অদ্বিতীয়। অদ্বৈত তত্ত্বে পরমাত্মা পরম চৈতন্য স্বরূপ হয়ে সর্বভূতে বিরাজমান। সর্বভূতে তিনিই - হাতিও নারায়ণ, মাহুতও নারায়ণ। তবে আমাদের হাতি নারায়ণের চেয়ে মাহুত নারায়ণের কথাই বেশি শোনা উচিৎ। উভয়েই নারায়ণ, কিন্তু হাতিতে তাঁর প্রকাশ কম, মাহুতে তাঁর প্রকাশ বেশী। এখানে, একটা কথা - এই 'প্রকাশ'। বিভিন্ন বস্তুতে তিনি বিভিন্ন ভাবে প্রকাশিত। অবতারে তিনি পূর্ণতর মাত্রায় প্রকাশিত, কোথাও কোথাও তিনি পূর্ণতম মাত্রায় প্রকাশিত। সাধারণ ভাবে আমরা দেখতে পাই কোন মানুষের বেশি ক্ষমতা ও দক্ষতা, কোন মানুষের কম। অর্থাৎ বিভিন্ন ব্যক্তিতে তিনি বিভিন্ন মাত্রায় প্রকাশিত। অবতারে তিনি অধিক পূর্ণরূপে প্রকাশিত। সব মানুষ সমান নয়। কিন্তু বীজে সবই এক। শুধু মানুষ নয় - বিভিন্ন প্রাণী, সূর্য-চন্দ্র সবই একই পরমেশ্বরের বিভিন্ন প্রকাশ।

শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণকে বলা হয় ভগবান বিষ্ণুর অবতার; শঙ্করাচার্যকে বলা হত নাকি তিনি শিবের অবতার। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর এই ত্রিদেব হলেন পরমাত্মার সত্যরজস্তম রূপ সাম্যের তিন প্রকাশ। দেব বলা হলেও অন্যান্য দেব দেবী অপেক্ষা তাঁরা অধিক মুক্ত এবং অনেকাংশে বলা চলে তাঁরা হলেন মুক্ত চৈতন্য। সৃষ্টির প্রয়োজনে সেই মুক্ত চৈতন্য নিজেকে প্রকাশ করেছেন ত্রিগুণাত্মক রূপ ভেদে। এখানে বিষ্ণু চৈতন্য সর্বাধিক প্রকাশিত হয়েছে শ্রীরামচন্দ্রে, শ্রীকৃষ্ণে। ঠিক তেমনই ভাবে শিব চৈতন্য পূর্ণতর রূপে প্রকাশিত হয়েছে শঙ্করাচার্যে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন