শুভ্রর ভেদতত্ত্ব
“গাহি সাম্যের গান…। সংগচ্ছদ্ধ্বম সংবদাদ্ধ্বম
সংবোমানমসি জানতম ...।“- সাম্যই গতি (পরিণতি)। আমরা সবাই এগিয়ে চলেছি সাম্যের
দিকে। যেখানে অসাম্য সেখানেই পীড়ন – টেনশন। আমরা সকলেই চাই সাম্য – সমান হতে। কারণ
সাম্যই যে গতি। কিন্তু আমরা জানি যে ভেদ না থাকলে চাকা ঘোরে না। উচ্চতার পার্থক্য
না থাকলে জলের প্রবাহ হয় না। চাপের পার্থক্য না থাকলে বায়ু প্রবাহ হয় না।
শূন্যস্থান না থাকলে পূরণের আর্তি জন্মায় না। কারখানায় উৎপাদন হয় না। সভ্যতার চাকা সচল রয়েছে এই ভেদের উপরে। তাহলে
সংসার তথা সভ্যতার প্রয়োজনে ভেদ প্রয়োজন। কিন্তু সাম্যই যে গতি ...। তাই কি ধরণের সাম্য আমরা চাই তা আমাদের ভাবার প্রয়োজন।
আমরা এমন সাম্য চাই যেখানে ভেদ থাকবে কিন্তু সেই ভেদ মানুষকে বেদনা দেবে না। মানুষ
প্রসন্ন চিত্তে এই ভেদকে সন্মান করবে।
কারণ ছাড়া কার্য হয় না। কর্মের মূলে কারণ। পদার্থ বিজ্ঞানে
এই সত্য আমরা বারবার উপলব্ধি করেছি। কিন্তু পদার্থ তো স্থূল জগতের অংশ। পদার্থ
বিজ্ঞানে আমরা দেখেছি কারণ যত স্থূল কর্মও তত স্থূল। যেমনঃ স্বল্প বল প্রয়োগে
বস্তুর স্বল্প আন্দোলন; অধিক বল প্রয়োগে বস্তুর অধিক আন্দোলন। কারণকে সূক্ষ্ম থেকে
সূক্ষ্মতর করলে যে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কর্মের উৎপত্তি ঘটে তা আমাদের দৃষ্টি গোচর নাও
হতে পারে। আর সকলের দৃষ্টি তথা উপলব্ধি তো সমান নয়। তাই কারণ স্বরূপ সমস্ত ঘটনা
সকলকে সমান ভাবে নাড়া দেয় না। আবার ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিকে ভিন্ন
ভিন্ন রূপে নাড়া দেয়। জগতের কোনো ঘটনাই অলৌকিক নয়। শুধু বস্তুর জগতকে ব্যতি রেখে
অধ্যাত্ম জগতের ঘটনাবলীকেও অলৌকিক বলা চলে না। অলৌকিক বলতে, যা লোকের বোধগম্য নয়।
কোনো ব্যক্তির বিদ্যুতের সম্বন্ধে জ্ঞান না থাকলে বিদ্যুৎ তথা আলো বা কোনো
বৈদ্যুতিন যন্ত্রের ক্রিয়াকে অলৌকিক বলে মনে হবে। আর কার্য কারণ সম্পর্কের মূলে
আছে ভেদ। কার্য-কারণ সম্পর্ক সূক্ষ্ম হলে ভেদও সূক্ষ্ম। বিভিন্ন কারণের একতা বা
সমন্বয় থাকলে তা কোনো বড় কার্যের কারণ হতে পারে। স্থূল জগতে বিভিন্ন সত্ত্বার
মধ্যে একটা তাই অতি আবশ্যক। তাই একতাই বল। তা সমাজের প্রয়োজনে – রাষ্ট্রের
প্রয়োজনে। তাই ভেদ যেমন প্রয়োজন একতাও তেমন প্রয়োজন। কিন্তু তুমি আমি ভেদ যুক্ত
হয়েও এক হই কিভাবে।
তুমি মানুষ আমিও মানুষ। তোমার রক্ত লাল - আমার রক্তও
লাল। তুমি আমি এক ভাষাতেই কথা বলি। তাই আমরা সমান – এক। কিন্তু তোমার দৃষ্টি আমার
দৃষ্টি এক হলেও একটা ফুলকে তুমি একরকম ভাবে দেখো আমি দেখি আরেক রকম ভাবে। তাই
ফুলটির মূল্য তোমার কাছে এক রকম আমার কাছে আরেক রকম।
একটি সহমতে আমাদের আসতেই হবে – ভেদ আমাদের প্রয়োজন। ভেদ
ছাড়া সংসার অচল। কিন্তু সাম্যই গতি – শান্তি।
আজ আমাদের দেশ নানা ভেদে বিভক্ত – উচ্চ-নীচ, বড়-ছোট,
তোমার অধিকার-আমার অধিকার। এই ভেদকে কেন্দ্র করেই আমরা হারিয়েছি আমাদের দেশের তথা
আমাদের জন্মভূমির একটা বড় অংশ। বলাবাহুল্য পাকিস্তান-বাংলাদেশের উৎপত্তির কারণ এই
ভেদ।
সুতরাং আমরা দেখছি, যে ভেদ সংসারের চালিকা শক্তি সেই
আবার কখনও ধ্বংসাত্মক রূপে সংসারের ক্ষতি সাধনে উদ্ধত। তাই ভেদতত্ত্ব সঠিক প্রয়োগ আমাদের বাঞ্ছনিয়। এই
প্রয়োগ হওয়া উচিৎ বিজ্ঞান ভিত্তিক। পদার্থ বিজ্ঞানে তথা বস্তু বিজ্ঞানের স্থূল
কার্য -কারণ সম্পর্ককে ছাড়িয়ে আধ্যাত্ম জগতের সূক্ষ্ম কার্য কারণ সম্পর্ককের
সাপেক্ষে আমাদের ভেদতত্বকে বাস্তুবায়িত করা প্রয়োজন। আধ্যাত্ম জগতের কথা এখানে
বলার কারণ – এই ব্রহ্মাণ্ডের যত সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর কার্য-কারণ সম্বন্ধাবলী তা
এই অধ্যাত্ম বিজ্ঞানেরই অন্তর্গত। এই জগতে সব কিছু সম্ভব – কোনো কিছুই অসম্ভব নয় –
যদি সেই কারণ সলীলের কারণ অন্বেষণ করতে পার। কিন্তু আমরা চাই এক সুন্দর সমাজ
ব্যবস্থা যা স্থায়ী; মানুষের মূল্যবোধ, সঠিক ভেদ জ্ঞান তথা বিচার জ্ঞানের বিকাশ।
বৈদিক যুগের প্রাক্কালে “সেই এক সাথে চলব, এক কথা বলব,
একই চিন্তা করব…” সুরের মাঝখান থেকে সামাজিক আমূল সংস্কারের মাধ্যমে সমাজে
চতুর্বণের সৃষ্টি এমনই এক ভেদ তত্ত্বের প্রয়োগ। আমাদের সংহিতা এই ভেদ তত্ত্বের
প্রয়োগ করেছেন এই চতুর্বর্ণের মধ্যে। হ্যা, ব্রাহ্মণ জ্ঞানার্জন এবং সমাজে জ্ঞানের
আলো বিতরণে ব্রতী থাকবেন; তাঁর এই কাজে সুরক্ষা প্রদান করবেন ক্ষত্রীয়; বৈশ্য
নেবেন তাদের ভরণ পোষণের দায়ীত্ব; শূদ্র্ দেবেন সেবা; আর সেবা কখনোই ছোটো কাজ নয়।
ছোটো সে’ই, যে বা যারা সেবার মহত্বকে কলঙ্কিত করেছেন।
আধুনিক যুগ বিজ্ঞানের যুগ – অধিক রূপে বলা চলে অপরা
বিদ্যার যুগ। এই যুগে মানুষের চাহিদা ও আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণের অঙ্গীকার নিয়ে অপরা
বিদ্যা নানা রূপে অবতীর্ণ। যে ভেদ সভ্যতার গতিকে স্থিতিশীল, সুশৃংখলিত করে রেখেছিল
তা অপরা বিদ্যার বিকাশে উদ্বায়ীত। আমাদের মনে রাখতে হবে বৈদিক যুগে, যে ভেদ
সভ্যতাকে স্থিতিশীল ও গতিশীল করেছিল তার ভিত্তি ছিল পরা বিদ্যা; আর পরা বিদ্যার
কারণেই অপরা বিদ্যার বিকাশ। বর্তমানে অপরা বিদ্যার বিকাশে চতুর্বর্ণের ভেদ
লুপ্তপ্রায় হবার ফলে সভ্যতার ধ্বংসাত্মক দিক গুলি প্রকট। আজ চতুর্বর্ণের ভেদ আমরা
মানি না। কিন্তু যখন কোনো ব্যক্তি জ্ঞান সাধনাকে নিজের জীবনের ব্রত করেন তিনি কি
ব্রাহ্মণের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন না! এটা আমাদের অবশ্যই মানতে হবে – সব কাজ সকলের
জন্য উপযুক্ত নয়। যিনি জ্ঞান সাধনায নিজেকে উৎসর্গ করেছেন তিনি কখনোই জ্ঞানের
বাণিজ্য করতে পারবেন না। বাণিজ্যে মন দিলে তিনি তার সাধনা থেকে চ্যূত হবেন। আবার
যিনি ব্যবসায় পারদর্শী তার দ্বারা সাধনা চলবে না। ক্ষত্রীয় দেন সুরক্ষা। তবে আজ
অপরা বিদ্যার যুগে ক্ষত্রীয়ের রাজ গুণ সুরক্ষা প্রদানের পরিবর্তে মানুষের ভীতি ও
শোষণের কারণ। শক্তির আস্ফালন রূপেই তার প্রকাশ। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যুগে নানা
ক্ষেত্রে যে পরিষেবা আমরা পাই – অ্যাকোয়া গার্ডের সার্ভিসিং থেকে শুরু করে বিমান
সেবিকা, মাল্টিন্যাসনাল কোম্পানীর সেক্রেটারি থেকে কোনো সাইন্টিফিক প্রোজেক্টের
সার্ভিস ইঙ্গিনীয়ার – তা তো শূদ্রেরই কাজ।
একথা স্পষ্ট – চতুর্বর্ণের ভেদ আমরা যেমন চাই না তেমনই
সমাজে চতুর্বর্ণের তথা চার প্রকার নির্দিষ্ট গুণের প্রয়োজনীয়তাও অস্বীকার করতে
পারি না। এই চতুর্বর্ণের ভেদ আমরা যে চাই না তা একান্ত রূপেই অপরা বিদ্যার বিকাশের
অবশ্যম্ভাবী ফল। চতুর্বর্ণের ভেদ লুপ্তপ্রায় হবার সাথে সাথে সমাজের নানা ব্যধি
তথা মূল্যবোধের হানি – বর্ণ সংকর – দ্বেষ প্রভৃতি প্রকাশমান। সমাজ যখন
ব্যধিগ্রস্ত, আর অপরা বিদ্যাই যখন এর কারণ তখন অপরা বিদ্যার বিকাশকে সঠিক দিশায়
পরিচালনা করা একান্তরূপেই কাম্য। অপরা বিদ্যা তথা আধুনিক বিজ্ঞান চর্চাকে আমরা
সঠিক দিশায় পরিচালনা করব। যা মানুষের মূল্যবোধের হানির কারণ হবে না। বিজ্ঞান দিয়ে
যেমন যা খুশি তাই করা যায় তেমনই ভ্রষ্টাচার স্তব্ধও করা যায়। ভ্রষ্টাচার স্তব্ধ
হলে সবাই সবার জায়গাটা উপলব্ধি করবেন।ব্রাহ্মণ যেমন আধিপত্য লাভের জন্য বা আধিক সম্পদ আহরণের জন্য ক্ষত্রীয় বা বৈশ্যের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন না শূদ্র যখন দেখবেন
জ্ঞান সাধনায় ব্রতী ব্রাহ্মণের সম্পদের অধিকার শুধু অপরের দানেই সীমাবদ্ধ – ভিক্ষা
অন্নে যিনি দিন নির্বাহ করেন – তখন তিনি অবশ্যই ব্রাহ্মণ হতে চাইবেন না।
অবশেষে তাঁর কথা স্মরণ করি যিনি সকলের চাহিদা তথা আশা আকাঙ্ক্ষা
পূরণে নিজেকে সদা ব্যস্ত রাখেন – অজ্ঞানীকে জ্ঞান প্রদান করেন; শক্তিহীনকে শক্তি
দেন; ধনহীনকে সম্পদের পথ বলে দেন – কিন্তু তিনি নিজে সর্বত্যাগী; বিস্ময়! তাঁর দান
পাত্র কখনও শূন্য থাকে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন