বুধবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২১

 

অহিংস না সহিংস - বুদ্ধ না কৃষ্ণ...

'অহিংসা পরম ধর্ম '। সকল ধর্ম তথা আদর্শের মধ্যে অহিংসাকে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হয়েছে সর্বকালে - সর্বদেশে। ধর্ম আমাদের শিখিয়েছেন মানুষ তাঁর সর্বোচ্চ সত্যে উপনীত হতে পারে অহিংসার মাধ্যমেই। অহিংসাই জীবনের পরম প্রাপ্তির পথে সকল বাধা দূর করতে আমাদের সাহাহ্য করে। আমরা কোথা থেকে এসেছি - কোথায় যাব - আমাদের স্বরূপ কি? - মোক্ষ পিয়াসী মানুষ তাঁর সন্ধান পান। পরম সত্য লাভ করে তিনি পৃথিবীর সকল বন্ধন মুক্ত হন। মানুষের ষড় রিপু এই আত্ম জ্ঞান লাভের পথে প্রধান বাধা। কাম-ক্রোধ-লোভ-মদ-মোহ-মাৎসর্য এই ষড় রিপুই জন্ম দেয় হিংসার যা মানুষকে আত্মজ্ঞান লাভের পথ থেকে চ্যুত করে। এ কারণেই অহিংসাকে পরম ধর্ম মানা হয়েছে। উপনিষদে বলা হয়েছে ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা। এই ষড় রিপু যা এই সংসার জাত তা একান্ত রূপেই মিথ্যা। এই ষড় রিপুকে যিনি জয় করতে পারেন তিনিই সেই পরম সত্যে উপনীত হতে পারেন। তাই অহিংসাই ব্রত। যুগে যুগে নানা মনিষী এই অহংসারই বানী প্রচার করে গেছেন। আমরা সবসময় চেয়েছি এমন এক সমাজ ব্যবস্থা যেখানে কোন হিংসা থাকবে না - মানুষ সবাই সবাইকে ভাল বাসবে - সর্বদা শান্তি বিরাজ করবে - যেখানে কোন শোষণ থাকবে না। কিন্তু এ জগৎ বড়ই বিচিত্র। এখানে শোষণ আছে, (অপ}শাসন আছে, দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার আছে - আবার প্রেম আছে, মানবিক মূল্যবোধও আছে, আছে সুজলা-সুফলা-শষ্য-শ্যামলা প্রকৃতি। পশু-পক্ষিদের মধ্যেও আছে যেমন বাঘ-সিংহ-হায়নার মতো হিংস্র প্রাণী আবার হাতি-হরিণ-গোরুর মতো অতি শান্তি প্রিয় প্রাণীও। অর্থাৎ এ জগতে হিংসা ও অহিংসা উভয়েই সমান ভাবে বিদ্যমান। সবচেয়ে বড় কথা এই যে একটিকে বাদ দিলে অপরটির স্থায়িত্বও বিঘ্নের মুখে পড়ে। মানুষের কথাই ধরি। আমরা অহিংসার পূজারি। কিন্তু হিংসা ছাড়া এক মুহুর্তও কি আমরা চলতে পারি? আমাদের চলা ফেরায় - জীবন ধারনে - প্রতিটি কাজে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে আমরা কি প্রতি নিয়ত অসংখ্য প্রাণীর নিধনের কারণ হচ্ছি  না? তাহলে সন্মার্গ, পরম প্রাপ্তি তথা মোক্ষ লাভের পরম উপায় হলেও এই সংসারের চাকা সচল রাখতে প্রয়োজন হিংসারও। কিন্তু কিভাবে। হিংসা তো আমাদের চরম লক্ষ্য থেকে দূরে নিয়ে যায়। ধর্ম আমাদের এর পথ বলে দিয়েছেন পুরুষার্থে। পুরুষার্থকে চরিতার্থ করেই আমরা মোক্ষের পথে পা বারাতে পারি। ধর্ম-অর্থ-কাম ও মোক্ষ। ধর্মের পথে আমাদের চাহিদা ও নীতিকে পরিচালিত করে আমরা আমাদের মোক্ষ লাভের পথে এগোতে পারি। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ সেই কথাই বলেছেন। স্ব স্ব জাতি তাঁদের স্ব স্ব ধর্ম পালন করবেন। ব্রাহ্মণ যেমন বিদ্যার্জনে নিজেকে ব্যস্ত রাখবেন, তেমনই ক্ষত্রীয়ের কাজ স্বধর্ম পালন করে পূর্ণ নীতি অবলম্বন করে ধর্ম রক্ষার প্রয়োজনে যুদ্ধ হতে পিছপা না হওয়া। যুদ্ধে অংশ গ্রহণ তাঁর পুরুষার্থকে চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যেই। এখানে যুদ্ধ হল নীতি পূর্বক হিংসা তথা systemetic violence   অহিংসা থেকে চ্যুত হয়েও আমরা পুরুষার্থকে চরিতার্থ করে মোক্ষের পদপ্রার্থী। এ হল জগতের তথা সংসারের নিয়ম। যতই হোক আমরা বেঁচে থাকি এই সমাজেই এই সংসারেই।  তাই পূর্ণ সন্মার্গ  তথা অহিংসা আমাদের এই সংসারের বাইরে নিয়ে যায় - চরম উত্তরণের পথে। কিন্তু সভ্যতার বিকাশের ধারাকে গতিশীল রাখতে কিছু হিংসার সাহায্য আমাদের নিতেই হয়। ভগবান বুদ্ধ তাঁর অষ্টাঙ্গিক মার্গে নির্বাণ লাভের পথ দেখিয়েছেন। কিন্তু আমাদের প্রয়োজন এই সভ্যতার বিকাশ - এক সুদৃঢ় সুস্থিত জগৎ সংসার। পুরুষার্থকে চরিতার্থ করেই যা সম্ভব। মহাত্মা গান্ধী তাঁর সত্যাগ্রহে সম্পূর্ণ অহিংস পথে জাতিয় আন্দোলনকে পরিচালিত করার পরামর্শ দিয়েছেন। এই নিয়ে বহু বিতর্ক থাকলেও আমাদেরও মনে রাখতে হবে ইংরেজদের বাহু বলের সামনে আমাদের প্রতিরোধ মূলক সংঘবদ্ধ হাতিয়ার রূপে তিনি অহিংসা ছাড়া আর কোন পথই পান নি। যদিও বাহুবলের প্রত্যুত্তরে বাহুবল তথা স্বধর্ম জাত বলই হল পুরুষার্থ  - সেই সময়ে জাতির কোন বাহু বল না থাকায় আত্মিক বলই ছিল তাঁর অস্ত্র। কিন্তু সেই সময়ে সমগ্র জাতি কি পূর্ণ সত্যাগ্রহের জন্য প্রস্তুত ছিল? অনেক ক্ষেত্রেই তিনি নানা গোষ্ঠীর সাথে নানা সমঝোতায় এসেছেন। দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রভাব মুক্ত হতে পারেন নি তিনি। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু জাতীর পুরুষার্থকে চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে বহির্বিশ্ব থেকে বাহু শক্তি অর্জন করে ইংরেজদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে লিপ্ত হয়েছিলেন। যদি প্রশ্ন তোলা হয়, বহির্বিশ্বের কাছ প্রাপ্ত সাহায্য জাতিকে কি পুনরায় নতুন সাম্রাজ্যবাদীর পিঞ্জরভূক্ত হবার দিকে ঠেলে দিত না? উত্তরে বলা যায় নেতাজী বহির্বিশ্ব থেকে যে বাহুশক্তি অর্জন করেছিলেন তার সৈনিক ছিলেন ভারতীয়রাই যারা নানা কারণে দেশের বাইরে যুক্ত ছিলেন। জাতির পুরুষার্থকে চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে যে বল ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রত ছিল দেশজ রসদের সাহায্য নিয়ে সেই বল একই ভাবে সেই আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধেও প্রযোজ্য হত। তাই এসম্বন্ধে দেশনায়ক পরিকল্পনাহীন ছিলেন একথা ভাবা অর্থহীন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন